উফ, আর ভালো লাগছেনা অফিসে যেতে.........
মনে মনে বলল হাদী। আর লাগবেও বা কিভাবে? অফিসে জয়েন করার পর তার সাথে যা ঘটছে রীতিমতো বিরক্তিকর। নতুন অফিসে ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করার পরে দেখলো তার অফিসে যিনি এমডি তিনি আর আর কেউ নন তারই একসময়ের সহপাঠিনী স্পর্শীয়া। পরে বুঝতে পারলো স্পর্শীয়ার বাবাতো এই কোম্পানির চেয়ারম্যান আর সেই সুবাদে তার এই পজিশন। ভার্সিটি লাইফ থেকে স্পর্শীয়া তাকে পছন্দ করতো সেটা সে জানতো কিন্তু কখনো সেটা গায়ে লাগায়নি। এখনতো রীতিমতো স্পর্শীয়ার সাথে সারাক্ষন থাকতে হয়। মাঝে মাঝে যখন স্পর্শীয়ার দিকে তাকায় তখন দেখে স্পর্শীয়া তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখন হাদীর অনেক অস্বস্তি বোধ করে।
বড় ধরনের অঘটন ঘটেছে গত সপ্তাহে স্পর্শীয়ার জন্মদিনে। সেখানে স্পর্শীয়া হঠাৎ করে হাদীর নাম ঘোষণা করে গান গাওয়ার জন্য কারন স্পর্শীয়া জানতো হাদী ভালো গাইতে পারে। তাই অগত্যা গান গাইলো তাও মায়ের গান। হাদী গান গাওয়ার আগেই বলেছিলো আজকের দিনে যিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই মা যার কারনে আজকে এই স্পর্শীয়া ম্যাডামকে আমরা পেয়েছি। সে মাকে নিয়ে আজকে আমার পরিবেশনা। অনেক আবেগ দিয়ে হাদী মায়ের গানটি গাইলো আর গাইতে গাইতে কখন যে নিজের চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো নিজেও জানেনা। গান শেষ হওয়ার পরে সবার চোখের পানি সাক্ষী দিচ্ছিলো তার গান কিভাবে সবার মন ছুঁয়েছে। সেই থেকেতো স্পর্শীয়ার মা বাবা হাদী বলতে পাগল। কিন্তু হাদীর কাছে এই সব অস্বস্তি লাগে। কারন ছোটবেলা থেকে সে একাকীত্ব পছন্দ করে। আর এইসব মায়াতে তাই সে জড়াতে চাইনা। তারপরেও কি আর করা.........
এই যে হাদী সাহেব.........
জী ম্যাডাম......
উফফ, তোমাকে না কত বলেছি আমাকে ম্যাডাম বলবেনা......
সরি ম্যাডাম, আর হবেনা......
আবার ম্যাডাম......নাহ তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। শুনো অফিসের পরে রেডি থেকো। আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে......
আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাডাম......
বাসায় আসতে আসতে অনেক দেরি করলো হাদী। তাহমিনা শপিং করছে আর তাকেও তার সাথে থাকতে হয়েছে।
নাহ... আর যাবেনা এই অফিসে এবং কোথাও তাকে পালাতে হবে। বাসায় এসে সে পালানোর পথ পেয়ে গেলো হঠাৎ করে। তার একটি চাকরির জয়েনিং লেটার এসেছে রাঙ্গামাটি থেকে। অনেক খুশি হলো হাদী কারন সে পালানোর জন্য এমন একটি জায়গা খুঁজছিলো। ছোটবেলা থেকে তার একটা জোঁক ছিলো সবকিছু ছেড়ে সে বৈরাগী হয়ে যাবে। রাঙ্গামাটি গেলে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা হলেও সেটার স্বাদ পাবে। রাতের মাঝে সবকিছু গোছগাছ করে বাড়ির মালিককে সব দেনা পাওনা মিটিয়ে সকালে রওনা হলো রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। ও হ্যাঁ... যাওয়ার আগে আরেকটি কাজ করলো সেটা হলো তার সিমটা চেঞ্জ করে নতুন করে আরেকটি সিম নিলো। নাম্বারটা শুধু জানে তার আব্বা আম্মা ও আপু। আজ নিজেকে তাই সদ্য খাঁচা মুক্ত পাখির মতো স্বাধীন মনে হচ্ছে.........
মোটামোটি দুইমাস শান্তিমত কাটালেও তৃতীয় মাসে এসে বিপত্তিটা দেখা দিলো। হঠাৎ করে হাদীর আব্বা ফোন দিয়ে জানালো তার আম্মা অনেক অসুস্থ। হাদী আর যাই হোক তার আম্মাকে অনেক ভালোবাসে তাই সাথে সাথে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সন্ধ্যায় যখন যে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো দেখলো তার সকল আত্মীয় স্বজন উপস্থিত। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো তার আম্মাও দিব্যি সুস্থ এবং সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। হাদীকে দেখে বলল তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি আসছি। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে......
কিছুক্ষণ পর হাদীর আম্মা রুমে আসলো এবং বলল......
তুই যে রাঙ্গামাটিতে চাকরি করিস, আমাদেরকে জানালিনা কেনো?
এমনিতেই, তার আগে বলো এভাবে আমাকে ডেকে আনার মানে কি?
মানে কিছুনা, তোমার আগামী পরশু বিয়ে। মেয়েটাকে তোমার আব্বার আর আমার অনেক পছন্দ, মেয়ে তোমারও পরিচিত। তুমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নাও......
আম্মা, এইসব পাগলামির মানে কি?
তোমার পাগলামি ছুটানোর জন্য এটা করা হচ্ছে। তুমি কি মনে করো নিজেকে? আমি কি জানিনা তুমি রাঙ্গামাটি কেনো গেছো? ছোটবেলার বৈরাগী হওয়ার চিন্তা আবার মনে জাগছে না? দাঁড়াও ছুটাচ্ছি তোমার বৈরাগী......
ও আমি না, তোমার বৈরাগী ছুটাবে তোমার বউ.....
হাদী কখনো তার আম্মার কথার অবাধ্য হতে পারেনা কারন অনেক ভালোবাসে তার আম্মাকে। তাই কিছু না বলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলো
বিয়ের অনুষ্ঠানে কনেকে দেখে মোটামোটি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। কারন কনে আর কেউ নয়...... তারই এককালের সহপাঠিনী এবং তার আগের অফিসের বস স্পর্শীয়া। একটা ঘোরের মধ্যে হাদীর সাথে স্পর্শীয়ার বিয়েটা হয়ে গেলো। হাদী যতবার-ই স্পর্শীয়ার দিকে তাকালো স্পর্শীয়ার চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো তোমার খবর আছে আজকে। যাক শেষ পর্যন্ত রাতে কনে নিয়ে বাসায় এসে পৌঁছালো। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে হাদী অনেক ভয়ে ভয়ে বাসর ঘরে আসলো তখন স্পর্শীয়াকে দেখে আসলে চমকে উঠলো। কারন হাদী মনে করেছিলো স্পর্শীয়া তাকে দেখলে হয়তো বকাঝকা শুরু করবে সেখানে সে দেখলো স্পর্শীয়া বিছানার এক পাশে বসে বসে কাঁদছে। হাদীর কেন জানি খুব খারাপ লাগলো তাই বিছানার পাশে বসলো এবং স্পর্শীয়াকে বলল......
কাঁদছো কেনো স্পর্শীয়া?
আচ্ছা আমি কি দেখতে খুব বেশি খারাপ হাদী?
কই নাতো? তুমি অনেক সুন্দরী, কেনো বলছো এইসব?
তাহলে তুমি সব সময় এমন এড়িয়ে চলতে কেনো? সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে তোমাকে পছন্দ করতাম আমি। কতো ভাবে তোমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি বুঝেও না বুঝার ভান করতে। যখন আমাদের কোম্পানিতে তুমি জয়েন করো বিশ্বাস করো আমি খুশিতে ঐ দিন ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু হুট করে তুমি আবার হারিয়ে গেলে। আমার অবস্থা তখন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমি তোমাকে খুঁজিনি। শেষ পর্যন্ত তোমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তোমাদের বাড়িতে আসলাম। তোমার মাকে দেখে কিছু না বলে শুধু উনাকে জড়িয়ে ধরে দুই ঘণ্টার মতো কেঁদেছি। তারপর উনার জোরাজোরিতে সব খুলে বললাম। তোমার হয়তো অবাক লাগছে আমি কেমন টাইপের মেয়ে একটি ছেলের জন্য এমন করছি। হাদী আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই এমন পাগলামি করেছি। তোমার মায়ের থেকে শুনলাম তুমি নাকি ছোটবেলা থেকে এমন। হঠাৎ করে করে হারিয়ে যাও। প্লীজ হাদী, তুমি যদি এমন করতে চাও আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যেও কারন আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা.........
এই বলে স্পর্শীয়া হাদীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। আর হাদী অনুভব করলো সারাজীবন যে মায়ার হাত থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে আজ নিজেই সেই মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। তাই হাদীও স্পর্শীয়াকে আপন করে জড়িয়ে নিলো। থাকুক না কেউ হয়ে সুখি আজ তার জন্য..........
লিখাঃ Asadur Rahman Hadi.